Broadcast India News.

Broadcast India News.

1st July, 2025

৩৪ বছরের একচ্ছত্র অধিকারী বাম শিবির আজ কোথায় ?

৩৪ বছরের একচ্ছত্র অধিকারী বাম শিবির আজ কোথায় ?

বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ক্ষমতা দখলের লড়াই যেমন আছে, তেমনই আছে ক্ষমতা হারানোর আর্তনাদ। যুগ পাল্টায়, এক একটা করে পাতা বাড়তে থাকে ইতিহাসের খাতায়। শাসক আসে-শাসক যায়, আবার কখনো প্রত্যাবর্তন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের উদাহরণ নেই বাংলায়। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটানা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের একচ্ছত্র অধিনায়ক ছিল বামেরা। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে পতন হয় ৩৪ বছরের লাল দুর্গের। তারপর যত সময় এগিয়েছে ততই বঙ্গ ইতিহাসের পাতায় ক্রমশ যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে লাল বিপ্লব।

গত ১৪ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে লাগামছাড়া দুর্নীতি বঙ্গ রাজনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এত ঘটনা-দুর্ঘটনার পরেও ৩৪ বছরের একচ্ছত্র অধিকারী বাম শিবির আজ কোথায়? ৫০ ও ৬০র দশকে যে বামপন্থী আন্দোলনের ধাক্কায় সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার, সেই বামেরাই যেন আজ শুধুই একটা পেরিয়ে আসা যুগ।

শাসক দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও, গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থ বামেরা। গত এক দশকে শাসক দলের চরম আর্থিক দুর্নীতি, মস্তানরাজ, শিক্ষক নিয়োগ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে বামেদের ব্যর্থতাও প্রতি পদে প্রমাণিত। একটা সময়ে বিজেপির সাথে জোট তৈরি করে বাংলায় পদ্মফুলের আগমন ঘটিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। সেই বিজেপির সাথে বামেদের চিরকাল আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। কিন্তু ভোটের আগে বামেদের ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ভোটারদের মনে।

একদিকে যখন বাংলার মানুষের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে বামফ্রন্ট, ঠিক সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বঙ্গ রাজনীতির প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠে এসেছে বিজেপি। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের পালস রেট ধরতে তৃণমূলের ‘ভাতা রাজনীতি’ অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বামফ্রন্টকে। যেকোনও সরকারি প্রকল্প যে সম্পূর্ণভাবে সরকার পরিচালিত সেকথাও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন বাম নেতা কর্মীরা। দিন আনা দিন খাওয়া সাধারণ মানুষ একপ্রকার বেদ বাক্য হিসাবে মেনে নিয়েছেন – বঙ্গ মসনদে জোরাফুল যতদিন, পায়ের উপর পা তুলে ভাতা চলবে ততদিন।

ভোট কেনার জন্য মানুষের করের টাকা ক্লাবগুলিকে বিলিয়ে দেওয়া এবং তাঁদের চিরমুখাপেক্ষী থাকার জন্য কিছু জনবাদী প্রকল্পের জনপ্রিয়তা আজ খাতায় কলমে প্রমাণিত। তবে রাজ্য বামফ্রন্ট ক্ষান্ত থেকেছে নেতিবাচক সমালোচনার গণ্ডিতেই, সুনির্দিষ্ট কোনও দিশা দেখাতেও সেইভাবে কোনও হোমওয়ার্ক নেই বামেদের।

একটা সময়ে তৃণমূল আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রায় সমার্থক ছিল। ‘পিকে স্ট্র্যাটেজি’ চালু হওয়ার পরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব একেবারে নির্মূল না হলেও কমে গিয়েছে বহুলাংশেই। ভোট রাজনীতির ভোট মাথায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক প্রকল্পের প্রত্যক্ষ সুবিধা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তবে সেই সুবিধা আদৌ কতটা লাভজনক তা নিয়ে কিন্তু মাথাব্যথা নেই সাধারণ মানুষের। চলতি কথায় খয়রাতি করেই একের পর এক ভোট বৈতরণী পার হচ্ছে রাজ্যের শাসক দল। প্রতি মাসের সামান্য কিছু অর্থ বা ভাতার বিনিময়ে সমাজের একটা বড় অংশকে দাবিয়ে রাখছে শাসক দল। কিন্তু এই প্রবণতার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে কতটা সচেতন হচ্ছেন সাধারণ মানুষ? রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে বামপন্থীরা আদৌ কতটা তৎপর সেটা নিয়েও কিন্তু থেকে গেছে বড় প্রশ্ন।

আরও পড়ুনঃ ৩৪ বছরের একচ্ছত্র অধিকারী বাম শিবির আজ কোথায় ?

বাংলার সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছেন যে, স্থায়ী সরকারি চাকরির দিন প্রায় শেষ। যেটুকু হবে, তা কতটা মেধার ভিত্তিতে বা টাকা-পয়সা লেনদেনের ভিত্তিতে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গরিব মানুষ এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তাঁরা শুধু দেখছেন, এই মুহূর্তে হাতে কী পাচ্ছেন। আমাদের রাজ্যের বহু মানুষ সেই ভাবে রাজনৈতিক সচেতন নন। তাদের বিপথে চালিত করে ভোট কিনে নেওয়া আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে সেই প্রবণতা বর্তমানে বেড়ে গিয়েছে শত গুণ। সর্বোপরি স্বল্প শিক্ষিত বা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির একটা বড় কাজ করতে পারত বাম শক্তি। তবে বামেদের চিরাচরিত আত্ম অহংকার হয়ত রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর বদলে নিজেদের আত্মত্যুষ্টিতেই সীমিত থাকতে একপ্রকার বাধ্য করেছে।

বাম আমলে সবাই যেমন ঝাঁকের কই-এর মতো ‘বামাচারী’ হয়ে উঠেছিলেন, এখন‌ও তেমন সকলেই ‘দিদিপন্থী’। তবু ক্ষমতা এক দিন না এক দিন হাত বদলাবেই। কালের নিয়মে আজকের শাসক‌ও এক দিন পরাজিত হবেন। তখন‌ও বাংলার মানুষ নতুন রাজার পক্ষ‌ই নেবেন। এমনটাই হয়ে এসেছে অতীতে। ক্ষমতার হস্তান্তর হলে রাজনৈতিক দলের পতাকাই বদলাবে। তবে সাধারণ মানুষের অন্তরআত্মা যতক্ষণ না জাগ্রত হবে ততক্ষণ বাংলা থেকে যাবে লঙ্কা হয়ে, আর শাসক চিরকাল রূপ নেবে রাবণের।